মিষ্টি আলুর রোগ ও তার প্রতিকার

মিষ্টি আলু দেশের সর্বত্রই কিছু না কিছু চাষ হয়ে থাকে। এতে প্রচুর শর্করা, খনিজ ও ভিটামিন এ বিদ্যমান। মিষ্টি আলুর চাষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মিষ্টি আলু ফলন কম হওয়ার প্রধান কারণ বিভিন্ন প্রকার পোকামাকড় ও রোগের আক্রমণ। মিষ্টি আলুর ফলন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এর রোগবালাই দমন অত্যাবশ্যকীয়। তাই নিম্নে মিষ্টি আলুর কয়েকটি মারাত্মক রোগের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

১. রোগের নাম : পাতা, বোঁটা ও কাণ্ডে দাগ পড়া (Alternaria leaf, petiole and stem spot) রোগ

রোগের কারণ: অলটারনারিয়া ব্যাটাটিকোলা (Alternaria bataticola) নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে।


রোগের বিস্তার :
আক্রান্ত লতা, বিকল্প পোষক ও বায়ুর মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। বৃষ্টি, আর্দ্র ও ঠাণ্ডা আবহাওয়া এ রোগ বৃদ্ধির সহায়ক। আক্রান্ত পাতার ওপর ছত্রাকের বীজ কণা সৃষ্টি হয় এবং পরে বাতাসের মাধ্যমে এক গাছ থেকে অন্য গাছে ছড়ায়।

রোগের লক্ষণ :
এ রোগ সাধারণত পুরাতন ও পরিপক্ব পাতায় বেশি দেখা যায়।
রোগের আক্রমণে পাতার গায়ে বাদামি রঙের চক্রাকার দাগ দেখা যায় যা গোলাকার সীমারেখা দ্বারা আবৃত থাকে।
অনেক দাগ একত্রিত হয়ে বড় দাগের সৃষ্টি করে।
দাগগুলো পুরাতন হয়ে গেলে পাতার আক্রান্ত স্থানের টিস্যু ভেঙে যায় ও পাতা ঝরে পড়ে।
দাগ কাণ্ড ও পাতার বোঁটায়ও দেখা যায়, দাগগুলো বড় হয়ে কাণ্ডকে ঘিরে ফেলে।          

রোগের প্রতিকার :       
ফসল সংগ্রহের পর আক্রান্ত গাছের পাতা পুড়ে ফেলতে হবে।
সুস্থ, সবল ও জীবাণুমুক্ত লতা ব্যবহার করতে হবে।
জমিতে শস্যপর্যায় অনুসরণ করতে হবে।
রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করতে হবে।
পাতায় দাগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে ইপ্রোডিয়ন গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন- রোভরাল ৫০ ডব্লিউপি) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম অথবা ডাইফেনাকোনাজল + এ্যাজোক্সিস্ট্রবিন গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন-এমিস্টার টপ ৩২৫ এসসি) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার গাছে স্প্রে করতে হবে।



২. রোগের নাম : নরম পচা (Soft rot) রোগ

রোগের কারণ : রাইজোপাস নিগ্রিক্যানস (Rhizopus nigricans) নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তার : আক্রান্ত টিউবারের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়।

রোগের লক্ষণ :
  • এ রোগের আক্রমণের ফলে আলুতে পানি ভেজা দাগ দেখা যায়।
  • এই রোগ হলে আক্রান্ত স্থানের তন্তু খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।
  • আক্রান্ত আলু দুইপ্রান্ত হতে দ্রুত নরম ও আর্দ্র হয়ে পচে যায়, যা হতে দুর্গন্ধ বের হয়।
  • আক্রান্ত আলুর উপরিভাগে সাদা মাইসেলিয়ামের পুরু স্তর দেখা যায়।
  • এছাড়া প্যাথোজেনের কালো বর্ণের ফ্রুটিং বডিও দেখা যা    
রোগের প্রতিকার :     
  • ফসল সংগ্রহের পর আক্রান্ত গাছের পাতা পুড়ে ফেলতে হবে।
  • জমি হতে টিউবার উত্তোলন, পরিবহন ও সংরক্ষণের সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে টিউবার আঘাতপ্রাপ্ত না হয়।
  • সংরক্ষণের আগে টিউবার ভালো করে কিউরিং করতে হবে।
  • এ রোগ কমানোর জন্য কাটা, ছেঁড়া ও থেঁতলানো টিউবার
  • বেছে শুধু নিখুঁত টিউবার সংরক্ষণ করতে হবে।
  • আলু গুদামজাত করার পরে সে ঘরে বায়ু চলাচলের সুব্যবস্থা রাখতে হবে।
  • আলু অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা ও শুষ্ক আবহাওয়ায় সংরক্ষণ করতে হবে।


৩. রোগের নাম : কালচে বা ব্লাক রট/চারকোল রট (Black rot-Charcol rot) রোগ

রোগের কারণ : ম্যাক্রোফোমিনা ফ্যাজিওলিনা/ডিপ্লোডিয়া নাটালেনসিস (Macrophomina phaseolina/Diplodia natalensis) নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে।

রোগের বিস্তার
গাছের পরিত্যক্ত অংশে জীবাণু বেঁচে থাকে এবং বাতাস, পানি ও পোকামাকড়ের মাধ্যমে রোগ ছড়ায়।
রোগের লক্ষণঃ
  • এ রোগের আক্রমণে গাছ খর্বাকৃতির ও হলুদ রঙের হয়।
  • পরে আক্রান্ত গাছ ধীরে ধীরে কাল হয়ে যায়।
  • গুদামজাত অবস্থায় টিউবারেও এ রোগ দেখা যায়।
  • টিউবারে এ রোগের আক্রমণে কাল দাগ পড়ে।
  • পরবর্তীতে পচন শুরু হয়ে পুরো টিউবারটি পচে নষ্ট হয়ে যায়।                    

রোগের প্রতিকার      
রোগমুক্ত মিষ্টি আলুর লতা লাগাতে হবে।
শস্যপর্যায় অবলম্বন করতে হবে।
কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন-অটোস্টিন) অথবা কার্বোক্সিন + থিরাম গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন-প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে তার মধ্যে লতা ডুবিয়ে শোধন করে নিয়ে জমিতে লাগাতে হবে।
সংরক্ষিত টিউবারকে এ রোগের আক্রমণ হতে রক্ষা করতে টিউবারকে সংরক্ষণের পূর্বে ভালোভাবে কিউরিং করে নিতে হবে।
এ রোগ কমানের জন্য কাটা, ছেঁড়া ও থেঁতলানো টিউবার
বেছে শুধু নিখুঁত টিউবার সংরক্ষণ করতে হবে।

ফসল উঠানোর পর মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন-ডাইথেন এম ৪৫) প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে মিশিয়ে টিউবারে স্প্রে করে সংরক্ষণ করতে হবে।


 ৪. রোগের নাম : পাতা কোঁকড়ানো বা লিফ কার্ল ভাইরাস (Leaf curl virus) রোগ


রোগের কারণ : লিফ কার্ল ভাইরাস (Leaf curl virus)-এর আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে।

রোগের বিস্তার
এই রোগ সাদা মাছি পোকার মাধ্যমে ছড়ায়।

রোগের লক্ষণ
এ রোগে আলুর পাতা মারাত্মকভাবে ছোট হয়ে যায়।
মিষ্টি আলুর পাতা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে কুঁকড়িয়ে যায়।
ফলন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
রোগের প্রতিকার     
রোগমুক্ত লতা লাগাতে হবে।
জমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
সাদা মাছি পোকা দমনের জন্য ডায়াফেনথিউরন গ্রুপের কীটনাশক (যেমন-পেগাসাস ৫০ এসসি) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।



ড. কে এম খালেকুজ্জামান
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব) মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই শিবগঞ্জ, বগুড়া,  মোবাইলঃ ০১৯১১-৭৬২৯৭৮, ইমেইলঃ zaman.path@gmail.com


source: AIS

Related Posts

0 Comments: