আমের ক্ষতিকর পোকা ও তার দমন ব্যবস্থাপনা

আমের শোষক পোকা

 
এ পোকা অন্য সব পোকার চাইতে আমের বেশী ক্ষতি করে থাকে। বাংলাদেশের সর্বত্র এবং আমের সবজাতে এ পোকা আক্রমণ করে থাকে। সারা বছর আমগাছে এই পোকাগুলি দেখা যায়।

ক্ষতির ধরণ

আম গাছে কচি পাতা বা মুকুল বের হওয়ার সাথে সাথে এগুলি সক্রিয় হয়ে উঠে। এ পোকা নিম্ফ ও পূর্ণবয়স্ক উভয় অবস্থায় আমগাছের সকল কচি অংশ থেকে রস চুষে খেয়ে বেঁচে থাকে। নিম্ফ গুলি আমের মুকুল থেকে রস চুষে খায় এতে মুকুল শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে ঝরে পড়ে। একটি হপার পোকা দৈনিক তার দেহের ওজনের ২০ গুণ পরিমান রস শোষন করে খায় এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত আঠালো রস মলদ্বার দিয়ে বের করে দেয় যা মধুরস বা হানিডিউ নামে পরিচিত। এ মধুরস মুকুলের ফুল ও গাছের পাতায় জমা হতে থাকে যার উপর এক প্রকার ছত্রাক জন্মায়। এই পোকার আক্রমণে আমের উৎপাদন শতকরা ২০-১০০ ভাগ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। তাছাড়া হপার আক্রান্ত গাছের বৃদ্ধি কমে যায়।

প্রতিকার

ক) আম বাগান সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে বিশেষ করে গাছের ডাল পালা যদি খুব ঘন থাকে তবে প্রয়োজনীয় পরিমান ছাঁটাই করতে হবে যাতে গাছের মধ্যে প্রচুর আলো বাতাস প্রবেশ করতে পারে
খ) অমের মুকুল যখন ৮/১০ সেন্টিমিটার লম্বা হয় তখন একবার এবং আম মটর দানার মত হলে আর একবার প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমন রাইজ) মিশিয়ে সম্পূর্ণ গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে
গ) আমের হপার পোকার কারণে সুটিমোল্ড রোগের আক্রমণ অনেক সময় ঘটে তাই সুটিমোল্ড দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে সালফার জাতীয় ঔষধ (যেমন ঔষধ) ব্যবহার্য কীটনাশকের সাথে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

ফল ছিদ্রকারী পোকা

 

আমের ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ ১৯৯৫ সাল থেকে চাঁপাই নবাবগঞ্জ এর বিভিন্ন উপজেলায় লক্ষ্য করা যায়। এর পর প্রায় প্রতি বছর এ পোকার আক্রমণ দেখা গেছে। বর্তমানে আম চাষীদের নিকট এ পোকা একটি অন্যতম সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত।

ক্ষতির ধরণ

আম মার্বেল আকারের হলেই এ পোকার আক্রমন শুরু হয় এবং আম পাকার পূর্ব পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। পূর্ণ বয়স্ক স্ত্রী পোকা আমের নিচের অংশে খোসার উপর ডিম পাড়ে। কয়েকদিনের মধ্যেই ডিম ফুটে কীড়া বের হয়। কীড়া খুব ছোট বিন্দুর মত আম ছিদ্র করে আমের ভিতর ঢুকে পড়ে এবং আমের শাঁস খেতে থাকে। পরে আটি পর্যন্ত আক্রমণ করে। আক্রান্ত স্থানটি কাল হয়ে যায়। আক্রান্ত স্থানে জীবাণুর আক্রমণের ফলে পচন ধরে যায়। বেশী আক্রান্ত আম ফেটে যায় এবং গাছ থেকে পড়ে যায়।

প্রতিকার

ক) আক্রান্ত আম সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে অর্থাৎ মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে এবং গাছের মরা ডালপালা ছেঁটে ফেলতে হবে। ফলে পোকার আক্রমণ কম হবে।
খ) আম বাগান নিয়মিত চাষ দিয়ে আগাছা মুক্ত ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে
গ) পোকার আক্রমণ দেখা দেওয়া মাত্র ফেনিট্রোথিয়ন বা ফেনথিয়ন জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে স্প্রে করতে হবে। তাছাড়া কার্বারিল জাতীয় কীটনাশক ২ গ্রাম/লিটার পানিতে অথবা কারটাপ জাতীয় কীটনাশক ১ গ্রাম/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা যায়। এক্ষেত্রে হারভেস্ট-এ ভাল ফল পাওয়া যায়।

মাছি পোকা

 

মাছি পোকা দ্বারা পরিপক্ক ও পাকা আম আক্রান্ত হয়। ফজলী, ল্যংড়া, খিরসাপাত সহ বিভিন্ন জাতের পরিপক্ক ও পাকা আম গাছে থাকা অবস্থায় এ পোকা আক্রমণ করে।

ক্ষতির ধরণ

স্ত্রী পোকা ডিম পাড়ার অঙ্গের সাহায্যে গাছে থাকা অবস্থায় পরিপক্ক ও পাকা আমের গা চিরে ডিম পাড়ে অর্থাৎ খোসার নিচে ডিম পাড়ে। আক্রান্ত স্থান থেকে অনেক সময় রস বের হয়। বাইরে থেকে দেখে কোনটি আক্রান্ত আম তা বুঝা যায় না। আক্রান্ত পাকা আম কাটলে ভেতরে সাদা রং এর কীড়া দেখা যায়। বেশী আক্রান্ত আম অনেক সময় পঁচে যায়। সাধারণতঃ এ পোকা আমের উপর এবং নিচ উভয় অংশে আক্রমণ করে।

প্রতিকার

ক) আম গাছে পাকার আগেই পরিপক্ক অবস্থায় পেড়ে আনা
খ) আক্রান্ত আম সংগ্রহ করে মাটির নিচে গভীর গর্ত করে পুতে ফেলতে হবে
গ) প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমের রসের সাথে ০.৫ গ্রাম সেভিন মিশিয়ে বিষটোপ বানিয়ে এ বিষ টোপ বাগানে রেখে মাছিপোকা দমন করা যেতে পারে
ঘ) আম পরিপক্ক ও পাকার মৌসুমে আমবাগানে ব্লিচিং পাউডার প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে স্প্রে করতে হবে
ঙ) আম পরিপক্ক ও পাকার মৌসুমে প্রতিটি আম কাগজ (ব্রাউন পেপার) দ্বরা মুড়িয়ে দিলে আমকে পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করা যাবে
চ) ফেরোমনের ফাঁদও ( মিথাইল ইউজেনল) ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে প্রচুর পুরুষ পোকা মারা যাবে এবং বাগানে মাছি পোকার আক্রমণ কমে যাবে।

কান্ডের মাজরা পোকা

 

বাংলাদেশের সর্বত্রই কমবেশী এ পোকার আক্রমণ দেখা যায় এবং খুব কম সংখ্যক গাছে আক্রমণ দেখা যায়।। তবে অনেক সময় সিরিয়াস পেস্ট হিসাবেও দেখা যায়।

ক্ষতির ধরণ

এ পোকা আম গাছের কান্ড ও শাখাকে আক্রমণ করে। আক্রমণ স্থান দিয়ে পোকার মল নির্গত হয়। ছোট গাছ আক্রান্ত হলে গাছ মারা যেতে পারে। আক্রান্ত শাখাগুলি সহজেই ভেঙ্গে যায়।

প্রতিকার

ক) গাছের কান্ড বা শাখায় কোন ছিদ্র দেখা গেলে ঐ ছিদ্র পথে সূঁচালো লোহার শিক বা সাইকেলের স্পোক ঢুকিয়ে পোকাটির কীড়াকে খুঁচিয়ে মেরে ফেলতে হবে
খ) ছিদ্রটি ভালভাবে পরিষ্কার করে তার মধ্যে কেরোসিন বা পেট্রোল ভিজানো তুলা ঢুকিয়ে ছিদ্রের মুখ কাদা দিয়ে ভালবাবে বন্ধ করে দিতে হবে।

পাতা কাটা উইভিল

 

নার্সারীতে চারা গাছের কচি পাতায় এই পোকার আক্রমণ বেশী দেখা যায়। তাছাড়া অনেক সময় বড় আম গাছের কচি পাতা কাটতেও দেখা যায়। এ পোকা সাধারণতঃ আম ছাড়া অন্য কোন গাছের ক্ষতি করে না।

ক্ষতির ধরণ

এ পোকা আম গাছের শুধু কচি পাতা কেটে ক্ষতি করে। কচি পাতার নিচের পিঠে মধ্যশিরার উভয় পাশে স্ত্রী পোকা ডিম পাড়ে এবং পরে পাতাটির বোঁটার কাছাকাছি কেটে দেয়। ভালো করে দেখলে কাঁচি দ্বারা কেউ কেটেছে বলে মনে হয়। এ পোকার আক্রমণে গাছের নতুন পাতা ধবংস হয়। বেশী আক্রমণে একটি ছোট গাছ পাতাশূন্য হতে পারে।

প্রতিকার

ক) নতুন কাটা পাতা মাটি থেকে সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে
খ) গাছে কচি পাতা বের হওয়ার সংগে সংগে ফেনিট্রোথিয়ন বা ফেনথিয়ন জাতীয় কীটনাশক ২ মিলি/ লিটার পানিতে স্প্রে করলে পোকার আক্রমণ রোধ করা যায়। তাছাড়া কার্বারিল জাতীয় কীটনাশক ২ গ্রাম/ লিটার পানিতে অথবা কারটাপ জাতীয় কীটনাশক ১ গ্রাম/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করলেও পোকার আক্রমণ রোধ করা যায়। এক্ষেত্রে হারভেস্ট-এ ভাল ফল পাওয়া যায়।

পাতার গল মাছি 

 

ক্ষতির ধরণ
কয়েক প্রকারের গল সৃষ্টিকারী পোকা আম গাছের কচি পাতায় আক্রমণ করে তাতে বিভিন্ন আকারের গল রোগের সৃষ্টি করে। পাতার উপর কিংবা নিচের পৃষ্ঠে কিংবা উভয় পৃষ্ঠে গল দেখা যায়। গল গুলি বিভিন্ন রং এর হয় যেমন- ধুসর, বাদামী, সবুজ, লাল ইত্যাদি। স্ত্রী পোকা আমের কচি পাতার নীচের দিকে ছিদ্র করে ডিম পাড়ে। ৩-৪ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে ম্যাগোট বা বাচ্চা পোকা বের হয়। পরে পাতার কোষ এবং টিস্যু সমুহে প্রবেশ করে রস খাওয়ার কারণে পাতায় গলের সৃষ্টি হয়। পাতায় গলের পরিমান বেশী হলে সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটে। অনেক সময় গাছের পাতা শুকিয়ে মারা যেতে পারে।

প্রতিকার

ক)আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে
খ) ঘনভাবে রোপণকৃত আম বাগানে ছায়া থাকে বিধায় আম গাছের পাতায় গলের আক্রমণটা বেশী হয়। এজন্য আম পাড়ার পরে কিছু ডালপালা ছাঁটাই করা ভাল
গ) ডাইমিথয়েট জাতীয় কীটনাশক ২ মিলি/ লিটার পানিতে দিয়ে স্প্রে করলে আমের পাতায় গল মাছি দমন করা যায়। অথবা ডেল্টামেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক যেমন মেজর ১ মিলি/লিটার পানিতে দিয়ে স্প্রে করলেও ভালো ফল পাওয়া যাবে।

এপসিলা পোকা

 

এপসিলা আমের একটি মারাত্মক ক্ষতিকর পোকা। বর্তমানে এ পোকার আক্রমণ তেমন একটা দেখা যায় না। তবে এপসিলা পোকার আক্রমণ হঠাৎ করে বিক্ষিপ্ত ভাবে কোথাও কোথাও অল্প করে হলেও দেখা যায়। চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলায় এটি তাবিজ পোকা নামে অনেকের নিকট পরিচিত।

ক্ষতির ধরণ

কচি পাতায় পাড়া ডিমের ভিতর ভ্রুণাবস্থায় থাকা প্রথম ধাপের নিম্ফ পাতার ভিতর থেকে রস চুসে খায় এবং এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত করে যার কারণে পত্রকক্ষে সুচালো মুখবিশিষ্ট সবুজ রংয়ের মোচাকৃতি গলের সৃষ্টি হয়। এই গল সৃষ্টি হওয়ার কারণে পত্রকক্ষে আর কোন নতুন পাতা বা মুকুল বের হতে পারে না। গাছে বেশী পরিমানে গল সৃষ্টি হলে গলযুক্ত ডগা শুকিয়ে যায় এবং গাছের বৃদ্ধি কমে যায় ও সেই সাথে আমের ফলন কমে যায়।

প্রতিকার

ক) অক্টোবর-নভেম্বর মাসে সমস্ত আম গাছ থেকে নিম্ফসহ গল (তাবিজ) সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে
খ) মার্চ এপ্রিল মাসে আম গাছের পাতায় এপসিলা পোকার ডিম পাড়ার ক্ষতচিহ্ন দেখতে পাওয়া গেলে প্রতি লিটার পানির সাথে ডাইমিথয়েট জাতীয় কীটনাশক ২মিলি/ লিটার হারে মিশিয়ে পাতা ও ডালপালা ভালভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। অথবা ডেল্টামেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক যেমন মেজর ১ মিলি/লিটার পানিতে দিয়ে স্প্রে করলেও ভালো ফল পাওয়া যাবে।


উৎসঃ ইন্টারনেট

Related Posts

0 Comments: