ভূট্টা ফসলের রোগ ও তার প্রতিকার
কে, এম, খালেকুজ্জামান
বাংলাদেশে ধান ও গমের পর ভূট্টা তৃতীয় ও উচ্চ ফলনশীল দানা জাতীয় ফসল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইহা বহুবিধ খাদ্য তৈরীতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং কোন কোন দেশে ইহা প্রধান খাদ্য। কিন্তু বাংলাদেশে সাধারনতঃ পশু, মুরগী ও মৎস্য খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ধান ও গমের তুলনায় এতে প্রায় ১১% আমিষ জাতীয় উপাদান রয়েছে। বিভিস্ন সমস্যার কারণে বাংলাদেশে ভূট্টার ফলন অনেক কম। তার মধ্যে রোগ একটা অন্যতম কারণ। বাংলাদেশে ভূট্টার মোট ২৮ টি রোগ সনাক্ত করা হয়েছে, তার মধ্যে ১৯ টি ছত্রাকজনিত, ১ টি ব্যাকটেরিয়াজনিত, ৩ টি ভাইরাসজনিত এবং ৫ টি কৃমিজনিত রোগ। ভূট্টার রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে ভূট্টার উৎপাদন অনেকাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব। ভূট্টার কয়েকটি প্রধান রোগ ও তাদের দমন ব্যবস্থা সম্পর্কে নিম্নে বর্ণনা করা হল।
১। রোগের নামঃ বীজ পচা, মুল পচা ও চারা ঝলসানো রোগ (Seed rot, root rot and seedling blight)
রোগের কারণঃ রাইজোকটোনিয়া (Rhizoctonia), ফিউজারিয়াম (Fusarium), স্লোরোসিয়াম (Sclerotium), পিথিয়াম (Pythium) ইত্যাদি ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তারঃ বীজ ও মাটির মাধ্যমে এ রোগটি ছড়ায়। মাটির আর্দ্রতা বেশী হলে ছত্রাকের আক্রমণের মাত্রা বেড়ে যায়।
রোগের লক্ষণঃ
- বীজ পচা এবং চারা নষ্ট হওয়ার কারণে সাধারণত ক্ষেতে ভূট্টা গাছের সংখ্যা কমে যায়।
- বপন করা বীজ পচে যায়।
- চারা গজানোর পুর্বেই বীজের অংকুর মরে যায়।
- চারা ঝলসে যায়।
- গোড়া ও শিকড় পচে যায়।
- শিকড় বাদামী থেকে কালো রং ধারণ করে।
- গজানো চারা ঢলে পড়ে ও মরে যায়।
প্রতিকারঃ
- সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত বীজ বপন করতে হবে।
- ফসল উঠার পর প্রখর রৌদ্রে (মার্চ-এপ্রিল মাসে) জমি চাষ করে ফেলে রাখতে হবে।
- উত্তমরূপে জমি চাষ ও পরিমিত রসে বীজ বপন করতে হবে, অর্থাৎ মাটিতে অধিক রস রাখা যাবে না।
- কার্বেন্ডাজিম (অটোস্টিন) অথবা কার্বোক্সিন + থিরাম (প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি) প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে শোধন করতে হবে।
২। রোগের নামঃ পাতা ঝলসানো রোগ (Leaf Blight)
রোগের কারণঃ হেলমিনথোসপোরিয়াম টারসিকাম (Helminthosporium Turcicum Syn. Bipolaris turcicum) নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তারঃ এ রোগের জীবাণু গাছের আক্রান্ত অংশে অনেক দিন বেঁচে থাকে। জীবাণুর বীজকণা বা কনিডিয়া বাতাসের সাহায্যে অনেক দূর পর্যন্ত সুস্থ গাছে ছড়াতে পারে। বাতাসের আর্দ্রতা বেশী হলে এবং ১৮-২৭ ডিগ্রি সেঃ তাপমাত্রায় এ রোগের আক্রমণ বেড়ে যায়।
রোগের লক্ষণঃ
- গাছের নীচের দিকের পাতায় লম্বা বা ডিম্বাকার দাগ দেখা যায়।
- পরে আক্রান্ত দাগগুলো আকারে বড় হয়।
- পরবর্তীতে গাছের উপরের অংশে বিস্তার লাভ করে।
- দাগগুলো শিরা বরাবর বাড়তে থাকে এবং ধূসর বর্ণ ধারণ করে।
- রোগের প্রকোপ বেশী হলে গাছের পাতা আগাম শুকিয়ে যায় ও গাছ মারা যায় যা অনেক সময় খরায় আক্রান্ত হয়েছে বলে মনে হয়।
প্রতিকারঃ
- রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করতে হবে।
- ফসল সংগ্রহের পর পাতা, কান্ড ইত্যাদি পুড়ে ফেলতে হবে।
- পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ এবং পরিমিত সার ও সেচ প্রদান করতে হবে।
- কার্বেন্ডাজিম (অটোস্টিন) অথবা কার্বোক্সিন + থিরাম (প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি) প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে শোধন করতে হবে।
- রোগ দেখা দিলে আক্রান্ত ফসলে প্রোপিকোনাজোল (টিল্ট ২৫০ ইসি) ১ লিটার পানিতে ০.৫ মিলি অথবা কার্বেন্ডাজিম (অটোস্টিন) ১ লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
৩। রোগের নামঃ ডাউনি মিলডিউ (Downy mildew)
রোগের কারণঃ পেরোনোস্কে¬রোস্পোরা সরগাই (Peronosclerospora sorghi) নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তারঃ মাটি, পোষক ও আক্রান্ত বীজ দ্বারা ছড়ায়।
রোগের লক্ষণঃ
- আক্রান্ত গাছ খর্বাকৃতি, দুর্বল ও বিবর্ণ হয়।
- আক্রান্ত পাতায় লম্বা লম্বা সাদাটে দাগ পড়ে।
- আক্রান্ত পাতার নীচে সাদা ছত্রাক এবং ছত্রাকের বীজকনা দেখা যায়।
- পুর্ণ বয়স্ক গাছ আক্রান্ত হলে মোচার আকার ছোট হয় অথবা অনেক সময় মোচা পুরোপুরি হয় না। এ রকম লক্ষণকে ক্রেজি টপ বলে।
প্রতিকারঃ
- রোগমুক্ত সুস্থ বীজ বপন করতে হবে।
- আক্রান্ত গাছ দেখা মাত্র তুলে পুড়ে ফেলতে হবে।
- জমি থেকে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
- মেটালেক্সিল + ম্যানকোজেব (রিভোমিল গোল্ড) প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।
আক্রান্ত গাছে মেটালেক্সিল + ম্যানকোজেব (রিভোমিল গোল্ড) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
৪। রোগের নামঃ পাতায় দাগ বা কারভুলারিয়া লিফ স্পট (Curvularia leaf spot)
রোগের কারণঃ কারভুলারিয়া (Curvularia lunate C. Maculans ) নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তারঃ বেশি আর্দ্রতা ও তাপমাত্রায় আক্রমণ বাড়ে। জীবাণু মাটিতে এবং আক্রান্ত গাছে থাকে, বাতাস ও পানি মাধ্যমে ছড়ায়।
রোগের লক্ষণঃ
- প্রথমে ভুট্টার পাতায় ছোট ছোট গোল অথবা ডিম্বাকৃতির হলুদাভ দাগ পড়ে।
- পরবর্তীতে এ দাগগুলো বাদামী রং ধারণ করে এবং আকারে বড় হয়ে কখনো কখনো প্রায় ১ সেমি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
প্রতিকারঃ
- রোগমুক্ত বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
- ফসলের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
- আগাম বীজ বপন রোগের প্রকোপ কমায়।
- রোগ দেখা দিলে আক্রান্ত ফসলে প্রোপিকোনাজোল (টিল্ট ২৫০ ইসি) ১ লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
৫। রোগের নামঃ কান্ড পচা রোগ (Stalk rot)
রোগের কারণঃ ফিউজেরিয়াম (Fusarium), ডিপ্লেডিয়া (Diplodia), পিথিয়াম (Pythium), আরউইনিয়া (Erwinia), সিওডোমোনাস (Pseudomonas) ইত্যাদি দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে ।
রোগের বিস্তারঃ খরিফ মৌসুমে এ রোগ বেশী হয়ে থাকে। জমিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশী ও পটাশের পরিমাণ কম হলে ছত্রাক জনিত কান্ড পচা রোগ বেশী হয়। শিলা বৃষ্টি বা শিকড় ক্ষত হলে আক্রমণ বাড়ে ।
রোগের লক্ষণঃ
- কান্ডের নীচের দিকে নরম ও পানি ভেজা দাগ পড়ে।
- শিলা বৃষ্টি বা শিকড় ক্ষত হলে আক্রমণ বেড়ে যায়।
- আক্রমণে গাছের কান্ড পচে যায় এবং গাছ মাটিতে ভেঙ্গে পড়ে।
প্রতিকারঃ
- সুস্থ ও সবল বীজ বপন করতে হবে। সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করতে হবে, বিশেষ করে নাইট্রোজেন ও পটাশ সার পরিমিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
- ফসল কাটার পর আর্বজনা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
- শস্য পর্যায় অনুসরণ করতে হবে।
- শিকড় বা কান্ড আক্রমণকারী পোকা দমন করতে হবে।
- কার্বেন্ডাজিম (অটোস্টিন) অথবা কার্বোক্সিন + থিরাম (প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি) প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে শোধন করতে হবে।
- ডাইফেনোকোনাজল (স্কোর ২৫০ ইসি) এক লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
৬। রোগের নামঃ মোচা ও দানা পচা রোগ (Ear rot/Cob and grain rot)
রোগের কারণঃ ডিপ্লোডিয়া (Diplodia), ফিউজারিয়াম (Fusarium), জিবেরেলা (Gibberella), পেনিসিলিয়াম (Penicillium), এসপারজিলাস (Aspergillus) ইত্যাদি ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তারঃ গাছে মোচা আসা থেকে পাকা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত বেশী হলে এ রোগের আক্রমণ বেশী হয়। পোকা বা পাখির আক্রমণে বা কান্ড পচা রোগে গাছ মাটিতে পড়ে গেলে এ রোগ ব্যাপকতা লাভ করে। এ রোগের জীবাণু বীজ অথবা আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশে বেঁচে থাকে। একই জমিতে বার বার ভূট্টার চাষ করলে এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
রোগের লক্ষণঃ
- প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত হলে পুরো মোচা ও দানা পচে যায়।
- আক্রান্ত মোচার খোসা ও দানা বিবর্ণ হয়ে যায়।
- স্বাভাবিক না পুষ্ট হয় না, দানা কুচকে অথবা ফেটে যায়।
- অনেক সময় মোচাতে বিভিন্ন দানার মাঝে বা উপরে ছত্রাকের উপস্থিতি খালি চোখেই দেখা যায়।
প্রতিকারঃ
- দানা বা ঘাস জাতীয় শস্য বাদ দিয়ে শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে।
- গাছের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
- পোকা ও পাখীর আক্রমণ হতে দানা রক্ষা করতে হবে।
- পরিপক্ক হওয়ার সাথে সাথে দেরী না করে মোচা সংগ্রহ করতে হবে।
- প্রোপিকোনাজোল (টিল্ট ২৫০ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে গাছে ৭-১০ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
৭। রোগের নামঃ পাতার ভাইরাস রোগ (Virus Disease)
রোগের কারণঃ ভাইরাস দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তারঃ ভাইরাস রোগ পোকা (কর্ণ প্লান্ট হপার), সরগম ও জংলী ঘাস দ্বারা ছড়ায়।
রোগের লক্ষণঃ
- গাছের পাতায় লম্বালম্বি শিরা বরাবর সরু বা চওড়া হলুদ দাগ দেখা যায়।
- আক্রান্ত গাছ খর্বাকৃতির হয়, গাছে খাদ্য উৎপাদন ব্যহত হয়।
- মোচা ছোট আকারের হয় এবং ফলন হ্রাস পায়।
প্রতিকারঃ
- আক্রান্ত গাছ উঠিয়ে পুড়ে ফেলতে হবে।
- জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
- দানা বা ঘাস জাতীয় শস্য বাদ দিয়ে শস্য পর্যায় অবল¤¦ন করতে হবে।
- কর্ণ প্লান্ট হপার এ রোগ ছড়ায়। তাই এ পোকা দমনের জন্য অ্যাডমায়ার প্রতি লিটার পানি ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
৮। রোগের নামঃ গুদাম পচা রোগ (Storage disease)
রোগের কারণঃ অ্যাসপারজিলাস (Aspergillus), পেনিসিলিয়াম (Penicillium) এবং রাইজোপাস (Rhizopus) নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তারঃ বীজে আর্দ্রতা বেশী থাকলে দানা পচা রোগ বেশী হয়।
রোগের লক্ষণঃ
- মোচা বা দানা ভালভাবে না শুকিয়ে গুদামে রাখলে দানা পচে যায় ও বিবর্ণ হয়, দুর্গন্ধ বের হয় ও অংকুরোদগম ক্ষমতা কমে যায়।
- দানায় বিষ তৈরী হয় যা মানুষ ও পশুর জন্য ক্ষতিকর।
- গুদামে পচন বেশি হলে ছত্রাকের উপস্থিতি খালি চোখে দেখা যায়।
প্রতিকারঃ
- ভূট্টা পাকলে মোচা তাড়াতাড়ি সংগ্রহ করতে হবে ।
- দানা ছড়ানোর সময় যেন ভেঙ্গে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- দানা শুকিয়ে ১২% আর্দ্রতায় গুদামজাত করতে হবে।
- গুদামে পোকার আক্রমণ রোধ করতে হবে।
- গুদামে তাপমাত্রা যেন না বাড়ে সে জন্য বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে।
- দানায় জলীয় অংশ কম রাখার জন্য বর্ষাকালে মাঝে মাঝে রোদ্রে শুকাতে হবে।
- কার্বেন্ডাজিম (অটোস্টিন) অথবা কার্বোক্সিন + থিরাম (প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি) প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে শোধন করতে হবে।
————————————–
লেখক:
উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব), মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, শিবগঞ্জ, বগুড়া।
ইমেইলঃ zaman.path@gmail.com
উৎসঃ কৃষি বার্তা
0 Comments: